এটি এক প্রজন্মের সবচেয়ে বড় সামরিক উদ্ভাবন।’ গত জুলাইয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ এক প্রকাশ্য সত্য স্বীকার করেছিলেন—ড্রোন শুধু সামরিক শিল্প নয়, ২১ শতকের যুদ্ধের চেহারাকেও বদলে দিয়েছে।
ইউক্রেন প্রয়োজনকে সুযোগে পরিণত করে রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষার মূল ভিত্তি হিসেবে এই মানববিহীন যানবাহন ব্যবহার করছে।
এখন মস্কোও এই প্রযুক্তিতে দক্ষতা অর্জন করেছে; কিয়েভকে প্রতিরোধ করতে এবং ন্যাটো সদস্য দেশের আকাশসীমায়, যেমন পোল্যান্ডে, অনুপ্রবেশ ঘটাতে ড্রোন ব্যবহার করছে।
এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই প্রতিযোগিতার লক্ষ্য শুধু সামরিক আধিপত্য নয়, অর্থনৈতিকভাবে বিলিয়ন ডলারের বাজারও। অসংখ্য স্টার্টআপ এই বিশাল শিল্পে অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করতে মরিয়া। ড্রোন প্রযুক্তির মূল চালিকাশক্তি হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, যা দিন দিন আরও প্রভাবশালী হচ্ছে। নবীন প্রতিষ্ঠানগুলো উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে ঐতিহ্যবাহী অস্ত্রশিল্পের বড় কোম্পানির সঙ্গে সফলভাবে প্রতিযোগিতা করছে। এতে বিনিয়োগকারীদেরও নজর পড়েছে।
এর উদাহরণ হলো যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন নির্মাতা অ্যান্ডুরিল। ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এই কোম্পানির সর্বশেষ অর্থায়ন পর্বে বাজারমূল্য ছুঁয়েছে ৩০ বিলিয়ন ডলার। ইউরোপেও তিনটি অতি-মূল্যবান কোম্পানি রয়েছে (১ বিলিয়ন ডলারের বেশি মূল্য): জার্মানির কোয়ান্টাম সিস্টেমস, হেলসিং এবং পর্তুগালের টেকেটার।
ঐতিহ্যবাহী প্রতিরক্ষা কোম্পানিগুলো নতুন খেলোয়াড়দের আগ্রাসন সীমিত করার চেষ্টা করছে এবং তথ্যকে ঘোলাটে করছে। তারা বলছে, ড্রোনগুলো নিচে ও ধীরে উড়ে, কিছু স্টার্টআপের মূল্যায়ন অযৌক্তিক, এবং ডিভাইসগুলো ‘অপ্রচলিত’ হয়ে যেতে পারে।
ব্রিটিশ কনসালট্যান্ট ও সাংবাদিক জিলিয়ান টেট ফাইনান্সিয়াল টাইমসে বলেছেন, ‘(ড্রোন যুদ্ধ) যুদ্ধের প্রকৃতি পরিবর্তন করেছে। সস্তা ড্রোন যদি ব্যয়বহুল জাহাজ ও বিমান ধ্বংস করতে পারে, যুদ্ধের ক্ষমতা ও অর্থনীতি উভয়ই বদলে যায়।’ এটি বোঝায়, ঐতিহ্যবাহী কোম্পানিগুলো নতুন প্রযুক্তিতে নিজেদের স্থান হারানোর সম্ভাবনা নিয়ে উদ্বিগ্ন।
ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনাও ড্রোন প্রস্তুতকারকদের পক্ষে কাজ করছে। ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উর্সুলা ভন ডার লেন ২৯ সেপ্টেম্বর ঘোষণা করেছেন, ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর জন্য ২ বিলিয়ন ইউরো বিনিয়োগ করা হবে। বিশেষত্ব হলো, অর্থ মূলত সামরিক ড্রোন ক্রয় ও উন্নয়নে ব্যবহার হবে।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়ার আগ্রাসনের পর ইউক্রেনের প্রতিরক্ষামূলক বাহিনী তাদের সংখ্যাগত ও সামরিক সীমাবদ্ধতা দূর করার জন্য দূরপাল্লার যানবাহন ব্যবহার করছে। এতে ছোট কিন্তু কার্যকর ফোর্স বড় শক্তির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে সক্ষম হচ্ছে।
স্পেনের প্রতিরক্ষা প্রতিষ্ঠান ইন্দ্র–এর অস্ত্র ও গোলাবারুদের পরিচালক ম্যানুয়েল রদ্রিগেজ সারেজো বলেন, ‘২০২৪ সালে ইউক্রেন দুই মিলিয়ন ড্রোন উৎপাদন করেছে, যা ২০২৫ সালে দ্বিগুণ হবে। সবকিছুই যুদ্ধের চাহিদা থেকেই উদ্ভূত হয়েছে।’
রাশিয়াও—কৌশলগত অস্ত্র হারিয়ে এবং অর্থনীতি যুদ্ধ ও আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞায় টলমল—সস্তা দূরপাল্লার যানবাহনের দিকে ঝুঁকছে। এসব তারা নিজস্বভাবে তৈরি করছে বা চীন ও ইরান থেকে কিনছে।
অনেক ড্রোন কেবল ইউক্রেনের বিরুদ্ধে নয়, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সীমান্তেও হানা দিচ্ছে এবং গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো, যেমন সাবমেরিন কেবল, ধ্বংসের হুমকি সৃষ্টি করছে। তাই ইউরোপ সীমান্তে একটি ‘অ্যান্টি-ড্রোন প্রাচীর’ তৈরি করছে, যার জন্য ৬ বিলিয়ন ইউরো বরাদ্দ হয়েছে এবং এটি ইউক্রেনের সঙ্গে সহযোগিতায় বাস্তবায়িত হবে। ইউক্রেন প্রতিদিন এই প্রযুক্তি পরীক্ষা করছে এবং যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার করছে।
প্রবৃদ্ধি
২০২৪ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) সদস্য দেশগুলোর প্রতিরক্ষা ব্যয় টানা দশ বছর বৃদ্ধি পেয়ে ৩৪৩ বিলিয়ন ইউরোতে (৩৯৯ বিলিয়ন ডলার) পৌঁছেছে। ২০২৫ সালে এটি ৩৮১ বিলিয়ন ইউরো (৪৪৩ বিলিয়ন ডলার) হতে পারে।
একই প্রবণতা ইউরোপীয় প্রতিরক্ষা খাতের কোম্পানির বাজারমূল্যেও প্রতিফলিত হয়েছে; ২০২০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে বাজারমূল্য দ্বিগুণ হয়েছে। মাদ্রিদে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক প্রতিরক্ষা মেলা ফেইন্ডেফ–এ সামরিক বা দ্বৈত-ব্যবহারযোগ্য ড্রোন উৎপাদন ও বিপণনকারী কোম্পানির সংখ্যা বিস্ফোরণমূলক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।
তবে সব প্রতিষ্ঠানই মানববিহীন যানবাহনের বিপ্লবকে সমান উৎসাহের সঙ্গে গ্রহণ করছে না। জার্মান প্রতিরক্ষা জায়ান্ট রাইনমেটাল–এর সিইও আর্মিন পাপারজার সেপ্টেম্বরে লন্ডনে আন্তর্জাতিক প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সরঞ্জাম প্রদর্শনীতে ‘ড্রোন বাবল’–এর সতর্কবার্তা দেন।
তিনি বলেন, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং ড্রোনের হামলা থামানোর প্রযুক্তি শীঘ্রই এই ডিভাইসের কৌশলগত ও বাজারমূল্য হ্রাস করবে। তবে পাপারজার তখন তার স্কাইনেক্স অ্যান্টি-ড্রোন কামান সিস্টেম বিক্রি করছিলেন, যা ইউক্রেনে সফলভাবে পরীক্ষা করা হয়েছে।
